ডেস্ক নিউজ: দেশের প্রথম ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ধলেশ্বরীটোল প্লাজায় দুর্ঘটনায় ছয়জনের প্রাণহানির পর এবার টনক নড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। পুলিশ বলছে, দুর্ঘটনার একদিন আগে রঙ করে বেপারী পরিবহনের পুরনো বাসটি ঢাকা-কুয়াকাটা রুটে চলাচলে জন্য সড়কে নামায় মালিকপক্ষ। একদিকে বাসের ফিটনেস সনদ তো ছিলোই না অন্যদিকে লাইসেন্স ছিলো না ড্রাইভারের। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাসচালক নুর উদ্দিন (৩০)।
এছাড়া ঘন কুয়াশায় সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মুন্সিগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। এতে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে যানবাহন চালকদের সচেতন ও সতর্ক থেকে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।
হাইওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বেপরোয়া গতি আর ওভারটেকিংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। এতে গত এক সপ্তাহে মহাসড়কটির মুন্সিগঞ্জ অংশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৮ জন। শুধুমাত্র চলতি বছরই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিকের বেশি মানুষ।
এছাড়া গত এক বছরে এ মহাসড়কে ঘটে যাওয়া প্রায় ৭০টি দুর্ঘটনার ২০টি ঘটেছে গত দুই সপ্তাহে। সবগুলো দুর্ঘটনার ধরন প্রায় একই রকম হাওয়াই উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সরেজমিনে সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে ঘুরে দেখা গেছে, সড়কটিতে একপাশে যানবাহন চলাচলের জন্য গতিসীমার নির্দেশনা রয়েছে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। তবে মূল সড়কের গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার।
তবুও সড়ক বিভাগের এমন নির্দেশনার তোয়াক্কা না করেই চলছে অতিরিক্ত গতির প্রতিযোগিতা এতে ব্যস্ত যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন। মহাসড়কে একাধিক দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ। সেখানে থাকা স্পিড গানে চোখে দেখা গেছে এক একটি যাত্রীবাহী বাসের গতি সর্বনিম্ন ৯৯ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২৪ পর্যন্ত।
গত ২৭ ডিসেম্বর দুপুরে ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় একটি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপাদেয় বেপারী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস। এতে প্রাণ গেছে চার নারীসহ ছয়জনের। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয় আরও অন্তত ১০ জন।
দুর্ঘটনা সিসিটিভি ফুটেজে, দেখা গেছে টোল প্লাজার কাছাকাছি এসে হঠাৎই নিজের গতি বৃদ্ধি করে বেপারী পরিবহনে যাত্রীবাহী বাসটি। এরপরই ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এতে অনেকটাই টনক নড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ঘটনার একদিন পর বাস চালক নুরুদ্দিন ও বাস মালিক ডব্লিউ বেপারীকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর পুলিশি তদন্তে মিলে রোমহর্ষক তথ্য একদিকে বাসের ফিটনেস সনদ তো ছিলোই না অন্যদিকে লাইসেন্স ছিলো না ড্রাইভারেরও।
এছাড়া ঘন কুয়াশায় গেল দুই সপ্তাহে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে সড়কের একাধিক পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে হাইওয়ে পুলিশের চেষ্টা চলাচ্ছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের।
সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা গেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হাতের ইশারায় যানবাহন থামিয়ে দেয়া হচ্ছে মামলা। এরপরও মিলছে না প্রতিকার। অভিযোগ আছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহারে অনিহা রয়েছে অনেকের এতে প্রায়ই গাড়ি চাপায় নিহত হচ্ছে অনেক পথচারী। সম্প্রতি ঘন কুয়াশায় গত দুই সপ্তাহে দুর্ঘটনা স্বীকার হয়েছে সাতটি যাত্রীবাহী বাস। ছয়টি প্রাইভেটকার, নয়টি পণ্যবোঝাই ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহন।
হাইওয়ে পুলিশের মতে, ঘন কুয়াশার মাঝেও চালকদের বেপরোয়া গতিতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে একমুখী রাস্তায় থেমে থাকা যানবাহনকে পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে দ্রুতগতির বাস-ট্রাক।
তবে চালকদের দাবি, ঘন কুয়াশায় মহাসড়কে নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, এছাড়া যত্রতত্র যানবাহন থামিয়ে রাখার কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা।
সরজমিনে দেখা গেছে, পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করে যত্রতত্র সড়ক পারাপার, বিভিন্ন যানবাহনের অবৈধ পার্কিং, যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানামাসহ ট্রাফিক আইন অমান্যের হিড়িক। নির্ধারিত গতিসীমা মানেন না বেশিরভাগ চালকেরা। এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ্টায় সবোর্চ্চ ৮০ কি.মি গতিতে গাড়ি চলার কথা থাকলেও সরেজমিনে হাইওয়ে পুলিশের স্পিডমিটারে দেখা যায়, অধিকাংশ গাড়ি মানছে না এসব নির্দেশনা। সর্বোচ্চ গতিতে চলছে প্রাইভেটকার ও যাত্রীবাহী বাস।
আরও পড়ুন: থানায় হামলা ও ভাঙচুর
তবে চালকরা বলছেন ভিন্ন কথা, ঘন কুয়াশায় পথ দেখতে সমস্যা হয় তাই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। রমজান আলী নামের ইলিশ পরিবহনের একজন বাসচালক বলেন, ঘন কুয়াশায় রাস্তায় গাড়ি পাকিং থাকে, তখন বিপরীর দিক থেকে আসা গাড়ি কুয়াশার জন্য খেয়াল করতে পারে না। যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।
বিভিন্ন যানবাহন চালকদের মতে, কুয়াশা বেশি ঘন হলে সড়কবাতি বা হেডলাইটেও কাজ হয় না। আর এতে করে গত কয়েকদিনে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ঘন কুয়াশার মাঝে একাধিক স্থানে অন্তত ১৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। সবগুলো দুর্ঘটনার ধরন প্রায় এক রকম। ঘন কুয়াশায় দেখতে না পেয়ে সড়কের ধীরগতির বা থেমে থাকা গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় অন্য গাড়ি। চালকদের দাবি, অতিরিক্ত গতি নয়,পর্যাপ্ত সড়ক বাতি না থাকাতেই কুয়াশায় থেমে থাকা গাড়ি দেখতে না পেয়ে দুর্ঘটনা।
তবে মুন্সিগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঘনঘন বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে সহজ ও নিরাপদ যাতায়াতের মাধ্যম এই মহাসড়কে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সড়কটিতে একমুখী প্রশস্ত সড়ক, ফ্লাইওভার,আন্ডারপাস, ইন্টার টেনসহ ধীর গতির যানবাহনের জন্য আলাদা সড়ক থাকা স্বত্বেও দুর্ঘটনার হটস্পট এখন এক্সপ্রেসওয়ে।
কিন্তু পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, ট্রাফিক আইন অমান্য করে চালকের বেপরোয়া গতি, কুয়াশায় গাড়ি চালানোর নিয়ম না মানা এবং অদক্ষতার কারণেই দুর্ঘটনা। এতে চালকদের সচেতন ও সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার দেওয়া আজাদ হোসেন।
এছাড়া হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল কাদের জিলানীর জানান, দ্রুত ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়া যান চলাচলের জন্য নির্মিত দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক। সড়কটিতে যত্রতত্র গাড়ি থামানোয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও পথচারীদের সড়ক পারাপারের জন্য আন্ডারপাস ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিয়ম মানছে না যেনো কেউ-ই। এতে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গত এক বছরে ৬৮টি দুর্ঘটনায় ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। তবে ২০২০ সালে চালু হয় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে শুধুমাত্র চলতি বছর মহাসড়কের মুন্সিগঞ্জ অংশে শৃঙ্খলা ভঙ্গেরদায়ে সড়ক পরিবহণ আইনে মামলা করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪৯৭টি।
এদিকে ঘন কুয়াশায় পরিস্থিতি অনুকূল না থাকলে সাময়িক সময়ের জন্য মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধের পরামর্শ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তার।
মুন্সিগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহমুদ সুমন বলেন, চালকদের দৃষ্টিসীমা দেখা যাচ্ছে না বলে সেক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় টোল প্লাজার আগে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখি। যাতে গাড়ি এসে যেনো কোনো দুর্ঘটনায় না পড়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটিকে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে বলা হয়। এর নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’। মহাসড়কটি নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা বিশ্বে বিরল। ৫৫ কিলোমিটার এই মহাসড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকা।
গত মে মাসে সড়ক ও মহাসড়কে বিভিন্ন যানবাহন কোন গতিতে চলাচল করতে পারবে, এ-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রকাশ করে সরকার। এতে বলা হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে এক্সপ্রেসওয়েতে কার, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাসের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, মিনিট্রাকসহ সব ধরনের মালবাহী যানের গতিবেগ সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার। আর মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। এই নীতিমালা কেউ মানছেন না।
বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ গতিসীমার এই নির্দেশনা শুধু স্বাভাবিক সময়ের জন্য প্রযোজ্য। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা হলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য গতিসীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ যতটুকু গতি হলে চালক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, সেই অনুযায়ী চালাতে হবে। তবে দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারে দেখা না গেলে যানবাহন চালানো বন্ধ রাখতে হবে। বৈরী আবহাওয়ায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
এছাড়া বৈরী আবহাওয়ায় সড়ক, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের ন্যূনতম গতিসীমা মানা হচ্ছে না। কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় সামনের কিছু একেবারে দেখা না গেলে যানবাহন চালানো একেবারে বন্ধ রাখার কথা বলা আছে; কিন্তু সেই নির্দেশনা কেউ মানছেন না। এ জন্যই ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়কে গত দুই দিন একাধিক যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
সড়ক সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন,গত দুই সপ্তাহে মুন্সিগঞ্জে এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। এ ছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা মহাসড়কটির সাইন-সংকেতব্যবস্থাও আধুনিক নয়,গতানুগতিক। এজন্য দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা উচিত।
Leave a Reply