ডেস্ক নিউজঃ একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রায় পাঁচ দশকের ব্যবধানে প্রথম কোনো পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে ভিড়েছে। গত বুধবার (১৩ নভেম্বর) পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে ছেড়ে আসা ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের জাহাজটি সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। এত বছর পর পাকিস্তান থেকে কনটেইনারবাহী ওই জাহাজ কেন বাংলাদেশে এলো, কেনই বা এটি এত তাৎপর্যপূর্ণ তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের পর ইতোমধ্যে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছে জাহাজটি।
জানা গেছে, ‘দুবাই টু চট্টগ্রাম’ রুট হয়ে করাচি থেকে বাংলাদেশে আসা কনটেইনারবাহী জাহাজটির পরবর্তী গন্তব্য ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের নিকটবর্তী এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের পর গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) জাহাজটি ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নতুন এই সার্ভিসটি চালু করেছে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘসময় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য হতো না। পরবর্তী সময়ে আবারও পাকিস্তানে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও দেশটি থেকে সাধারণত সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসতো না। প্রথমে শ্রীলঙ্কায় কনটেইনার খালাস করতো পাকিস্তানের জাহাজ, এরপর অন্য জাহাজে শ্রীলঙ্কা থেকে সেসব কনটেইনার বাংলাদেশে আসতো।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল থাকলেও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সীমিত হতে থাকে। একপর্যায়ে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে দেশটি থেকে আমদানি করা অধিকাংশ পণ্য ‘লাল তালিকাভুক্ত’ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অবশ্য, আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পাকিস্তানের অনুরোধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর দেশটির সব ধরনের পণ্য ‘লাল তালিকা’ থেকে মুক্ত হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে নানা তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে।
পাকিস্তান থেকে কনটেইনারবাহী জাহাজের সরাসরি বাংলাদেশে আসার খবর প্রকাশের পর থেকে বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও বিষয়টি নিয়ে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে আসা ওই জাহাজটিতে ৩৭০টি কনটেইনার ছিল। তবে সেসব কনটেইনারে কোন ধরনের পণ্য ছিল তা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেননি তিনি।
এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩৩৭ টন ওজনের ওই ৩৭০টি কনটেইনারে যেসব পণ্য আনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফ্রেবিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট ও ডলোমাইট। এর মধ্যে ১১৫টি কনটেইনারে রয়েছে সোডা অ্যাশ। আর ডলোমাইট রয়েছে ৪৬টি কনটেইনারে। তবে সব কনটেইনার করাচি থেকে জাহাজে লোড হয়নি। এরমধ্যে ২৯৭টি করাচি থেকে এবং বাকিগুলো দুবাই থেকে জাহাজটিতে লোড করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করাচি থেকে বাংলাদেশে আসা কনটেইনারগুলোর মধ্যে বেশিরভাই টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল রয়েছে। এছাড়াও কাঁচ শিল্পের কাঁচামালসহ গাড়ির যন্ত্রাংশ, রং ও কাঁচামাল কাপড় রয়েছে সেগুলোয়। আর ৪২টি কনটেইনারে পেঁয়াজ এবং ১৪টি আলু রয়েছে। আজিক গ্লাস কারখানা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, নাসির গ্লাস, এক্স সিরামিকস, প্যাসিফিক জিনস, হাফিজ করপোরেশন, এম আর ট্রেডিংস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য আমদানি করেছে। এছাড়া খেজুর, মার্বেল ক্লক, কপার ওয়্যার, জিপসাম, লোহার টুকরো ইত্যাদি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে। তবে একটি কনটেইনারে অ্যালকোহলজাতীয় পণ্যও রয়েছে বলে জানা গেছে।
সরাসরি পাকিস্তান থেকে দেশে কনটেইনার আসার বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, আগেও খোলাভাবে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পণ্য আসতো, যা এখনো চলমান। তবে সেগুলো তৃতীয় কোনো দেশে খালাসের পর জাহাজ বদল হয়ে বাংলাদেশে আসে। তবে পাকিস্তান থেকে সরাসরি এবারই প্রথম কনটেইনার এসেছে। এগুলো ‘সিলড উইথ কার্গো, মানে এগুলো মালপত্র বোঝাই।’ আর এসব কনটেইনারে কী আছে, তা কেবল এজেন্ট এবং কাস্টমস জানবে।
যদিও সাধারণত কনটেইনারে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি থেকে শুরু করে ইকুইপমেন্ট, সব পণ্য আসে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী। আর এ ক্ষেত্রে কনটেইনারের আকার ছাড়া কোনো নিষেধাজ্ঞা (রেস্ট্রিকশনস) নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
Leave a Reply