ডেস্ক নিউজ : সারাবিশ্বে বিভিন্ন ভাষা রয়েছে। সেসব ভাষায় অসংখ্য মানুষ কথা বলেন। আর প্রতিটি মানুষের কাছে তার নিজ ভাষা মধুর ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে এমন ভাষাও রয়েছে, যে ভাষায় মাত্র দু’জন মানুষ কথা বলেন। সেটিও তারা দুই বোন। আর ভাষার নাম খাড়িয়া ভাষা। যা পারসি ভাষা হিসেবেও পরিচিত।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানের অদূরে বর্মাছড়া খ্রিস্টান পাড়ার দুই বোন ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা ও ভেরোনিকা কেরকেট্টা বসবাস করেন। তারা দুই বোন এই খাড়িয়া ভাষায় কথা বলেন। তাদের মা-বাবা এখানে এসেছিলেন ভারতের রাঁচি থেকে। তারা মা-বাবার কাছে খাড়িয়া ভাষায় কথা বলা শিখতে পারলেও এ ভাষায় লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না তাদের জন্য।
চা শ্রমিক ক্রিস্টিনা আক্ষেপ করে বলেন, আমরা দুই বোন আছি। আমরা যদি মারা যাই তাহলে শেষ হয়ে যাবে এই ভাষা। আমাদের দুই বোনের মতো আর কেউ কথা বলতে পারবেন না। আর তার বড় বোন সত্তরোর্ধ ভেরোনিকা বলেন, আমাদের দুই বোনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষাও শেষ হয়ে যাবে।
খাড়িয়া সমাজ প্রধান, ভাষা গবেষকরা জানান, বাংলাদেশে শুধু তারা দুই বোনই কেবল খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে প্রতিবেশী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে প্রয়োজন হলে বাংলা, বাগানি ও সাদরি ভাষায় কথা বলেন তারা। কেননা, পরিবার, পরবর্তী প্রজন্ম বা গ্রামে কোথাও এমন কেউ নেই, যিনি খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। মাতৃভাষার চর্চা, বইপত্র ও সংরক্ষণের অভাবে ভাষাটি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেট অঞ্চলের ৩৫টি চা বাগানের গ্রামে তিন থেকে পাঁচ হাজারের মতো খাড়িয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। খাড়িয়া সমাজ প্রধান জহরলাল পাণ্ডে জানান, মাত্র ১০-১৫ জনের মতো খাড়িয়া ভাষার কয়েকটি শব্দার্থ জানেন এবং বোঝেন। সবমিলে বাংলাদেশে খাড়িয়াদের ভাষা এখন মৃতপ্রায়।
জহরলাল পাণ্ডে বলেন, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছে। বাগানের জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা এসেছেন। তারা যে ভাষা জানতেন, সেটা ব্যবহার করতেন। আমার এখন বুঝতে পারছি বিষয়টি। কিন্তু কীভাবে এ ভাষাটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ বা বাঁচিয়ে রাখব, সেটা জানি না। এখন যেমন তারা দু’জন (ক্রিস্টিনা ও ভেরোনিকা) আছে। তারা যদি চলে যায় তাহলে এই ভাষা বাংলাদেশে থাকবে না।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে: ক্রিস্টিনা ও ভেরোনিকা খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারলেও তারা এ ভাষায় বলতে বা লিখতে পারেন না। আমাদের দেশে এ ভাষার কোনো বইপত্র বা শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। আবার চা বাগান এলাকায় মিশ্র জাতির বসবাস হওয়ায় সেখানে এখন প্রচলিত ভাষা ও বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
ক্রিস্টিনা জানান, তাদের সন্তানরা স্কুলে যায়। বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করে, কথা বলে ও বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে।
বর্মাছড়া গ্রামের শিশুরা যে স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নেয়, সেখানে অন্তত আটটি নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। বর্মাছড়া শিশু শিক্ষাকেন্দ্র শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ থেকে ২০ জনের মতো খাড়িয়া শিশু রয়েছে। স্কুলে দু’জন খাড়িয়া সম্প্রদায়ের শিক্ষিকাও রয়েছে। কিন্তু তারাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এদেরই একজন লিজা নানোয়ার বলেন, এখানে আমরা খুব সংখ্যালঘু। জন্ম থেকেই আমরা ভাষাটি শুনিনি। দু’একজন অবশ্য পারে। তারা বাড়িতে ব্যবহার করে ভাষাটি। আমরাতো সামগ্রিকভাবে ভাষাটি পাইনি। শুধু মৌখিকভাবে শুনেছি। বইও দেখিনি আমি। বলা যায় ভাষাটা আমরা হারিয়ে ফেলছি। আর এখানে স্কুলে পড়ানোর মাধ্যম হলো বাংলা। এ অবস্থায় এটা বুঝতে পারি যে আসলে অনেক কিছুই হারিয়েছি আমরা।
ভাষা সংরক্ষণের দাবি: ভারতের উড়িষ্যা এবং ঝাড়খণ্ডে প্রচলিত রয়েছে খাড়িয়া ভাষা। সেসব অঞ্চলে এ ভাষার শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। বইপত্র ও ব্যাকরণও রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণ কিংবা পাঠদানের কোনো ব্যবস্থা নেই।
এ ব্যাপারে ক্রিস্টিনা বলেন, আমাদের দেশে খাড়িয়া জাতি পাবেন। এ জাতির মানুষ পাওয়া গেলেও এই ভাষা পাবেন না। তবে ভারতেই আমাদের জাতি রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। দেখাও করতে পারি না। আমাদের ভয় হয়। কেননা, আমাদের তো পাসপোর্ট নেই। আবার তেমন অর্থও নেই, তাই করতে পারি না।
মৃতপ্রায় খাড়িয়া ভাষা ধরে রাখার জন্য নাতি-নাতনির সঙ্গে এ ভাষাতেই কথা বলেন ভেরোনিকা। তিনি বলেন, খাড়িয়া ভাষায় যেন বইপত্র হয়। আমাদের সন্তানরা পড়ালেখা করছে, শিক্ষিত হচ্ছে। এ জন্য তারা বই পেলে পড়ালেখা করে বুঝতে পারবে এই ভাষা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর ইমতিয়াজের পিএইচডির বিষয় ভাষা সংরক্ষণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মৃতপ্রায় ভাষার মধ্যে একটি খাড়িয়া ভাষা। এখন দু’জন আছেন যারা এ ভাষায় কথা বলতে পারেন। এখন তারাও যদি হারিয়ে যায়, তাহলে হারিয়ে ফেলা হবে যে কীভাবে বাংলাদেশে খাড়িয়া ভাষা এসেছিল। সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি, গল্প বা ধারনা, সবই হারিয়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ভারতে যেহেতু খাড়িয়া ভাষা ও ব্যাকরণ সংহত রয়েছে, এ জন্য ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভাষাটিকে যদি সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে শুধু এ ভাষাকেই আমরা সংরক্ষণ করছি না। বরং ওই জাতীয় সব মানুষের গল্প, ইতিহাসও জেনে রাখতে পারছি। এ জন্য বিপন্ন ভাষার মতো খাড়িয়া ভাষাও সংরক্ষণ করা খুবই প্রাসঙ্গিক।
বিপন্ন ভাষা টিকিয়ে রাখার পদ্ধতিকে ভাষাবিজ্ঞানের ভাষায় ল্যাঙ্গুয়েজ রিভাইটালাইজেশন বা ভাষার পুনরুজ্জীবিকরণ বলা হয়। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, একদম নবীন পর্যায়ে যেসব খাড়িয়া শিশুরা রয়েছে, তারাও বাংলা বর্ণমালা শিখছে। এ জন্য প্রথমেই খাড়িয়া ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ এবং সেটিকে বাংলাদেশের মানুষের উপযোগী করে প্রস্তুত করা। এরপর খাড়িয়াভাষী শিশুদের উপযোগী করে বইপুস্তক প্রণয়ণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি, স্থানীয় বা সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
Leave a Reply