আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের হাজার হাজার কৃষক মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানী দিল্লির দিকে মিছিল করে এগোতে শুরু করেছেন। সোমবার বেশি রাত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় পদযাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কৃষক নেতারা। খবর বিবিসির।
হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লির দিকে আসার জাতীয় মহাসড়কে কংক্রিট আর পেরেক পুঁতে, কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়ে বহু স্তরীয় ব্যারিকেড করেছে পুলিশ। একাধিক স্তরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। দিল্লিতে আগামী একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে।
ট্রাক্টর আর লাঠিসোঁটা দিয়ে ওইসব ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, এমন ভিডিও প্রকাশ করেছে সংবাদ সংস্থা এএনআই।
তারা জানাচ্ছে, হরিয়ানা থেকে দিল্লির রাস্তায় শাম্ভু সীমান্তে কৃষকরা ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়।
বার্তা সংস্থা এএনআই বলছে, পুলিশ কাঁদানে গ্যাস আর জল-কামান চালাতে শুরু করলেই অনেক কৃষককে পাশের ক্ষেতের দিকে দৌড়তে দেখা যায়। কয়েকজন কৃষককে পুলিশ আটক করেছে বলেও জানা যাচ্ছে।
এর আগে, ২০২০ সালেও হাজার হাজার কৃষক প্রস্তাবিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অনেক মাস লাগাতার অবস্থান করেছিলেন দিল্লির তিনটি সীমান্তে।
কেন কৃষকদের আন্দোলন?
বছর তিনেক আগে দিল্লির সীমান্তে যে অবস্থান করেছিলেন কৃষকরা, তার পরে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি আইনই বাতিল ঘোষণা করে দেয়। সেই আন্দোলনের সময়ে কৃষকদের বিরুদ্ধে যত মামলা দায়ের করেছিল পুলিশ, সেই সব মামলা প্রত্যাহার, নূন্যতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা আর সব কৃষি ঋণ মকুব করার দাবিতে এবারে আন্দোলনে নেমেছেন কৃষকরা।
নূন্যতম সহায়ক মূল্য হল সরকারের স্থির করে দেওয়া যে দামে কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করতে পারবেন। এই দামের থেকে বেশি দাম পেতেই পারেন কৃষকরা, কিন্তু এর থেকে কম নেওয়া যাবে না।
কৃষকরা দাবি করছেন নূন্যতম সহায়ক মূল্য স্থির করতে হবে স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী।
মন্ত্রীদের সঙ্গে কৃষকদের বৈঠক ব্যর্থ
মঙ্গলবার সকাল দশটা নাগাদ কৃষকদের মিছিল শুরু হওয়ার আগে গতরাতে নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। খাদ্য ও ক্রেতা বিষয়ক মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল, কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই চণ্ডীগড়ের ওই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে অর্জুন মুন্ডা বলেন, “কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে হয়েছে। সরকার সব সময় চায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হোক। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা এখানে এসেছি।”
“অনেক বিষয়ে আমরা ঐকমত্য হয়েছি। কিন্তু এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর সঙ্গে অন্য অনেক ব্যাপার জড়িত। ওই বিষয়গুলির আপাতত সমাধান করতে আপাতত একটা কমিটি গড়া হোক। সেই কমিটিতে আমরাও আমাদের দিকটা তুলে ধরব, যাতে বিষয়গুলির স্থায়ী সমাধান বার করা যায়,” জানিয়েছেন অর্জুন মুন্ডা।
তার কথায়, “আমরা বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা আশাবাদী যে আমরা সবাই মিলে সমাধান খুঁজে বের করতে পারব। আমরা কৃষক ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করব। আমরা এখনও আশাবাদী যে কৃষক ইউনিয়নগুলি আলোচনা করবে।”
কী বলছেন কৃষক নেতারা?
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আহ্বায়ক জগজিৎ সিং ধালিওয়াল বলেন, “দীর্ঘক্ষণ ধরে বৈঠক চলেছে, বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে এগুলি কিন্তু আমাদের দাবি ছিল না, সবগুলোই ছিল সরকারের নানা সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি।”
“এখন সরকার বলছে ঐকমত্য হতে হবে, তার জন্য কমিটি গড়া হবে,” বলছিলেন মি. ধালিওয়াল।
তিনি আরও বলেন, “এর আগেও নূন্যতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া অনেক আলোচনার পরে এম স্বামীনাথন কমিটি রিপোর্ট দিয়েছিল, সেটাও বাস্তবায়ন করা হল না। ঋণ মকুবের প্রশ্নে সরকার এ নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না। যদিও কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা মকুব করেছে সরকার।“
গতরাতের ওই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পরেই কৃষক নেতারা ঘোষণা করেন যে মঙ্গলবার সকাল দশটা নাগাদ তারা দিল্লির দিকে মিছিল শুরু করবেন।
আন্দোলনের নেতৃত্ব কাদের?
পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের কৃষকদের দুটি বড় সংগঠন ‘সংযুক্ত কিষান মোর্চা’ এবং ‘কিষান মজদুর মোর্চা’ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদের অধীন পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশের সাড়ে তিনশোটি ছোট-বড় কৃষক সংগঠন রয়েছে।
তবে উত্তর ভারতের অন্যতম প্রধান কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত এই আন্দোলনে যোগ দেন নি। তিনি ২০২০ সালের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন।
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত বিবিসিকে জানিয়েছেন যে তারা নজর রাখছেন এই আন্দোলনের ওপরে।
তার কথায়, “আমরা নজর রাখছি। সরকার আর কৃষকদের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ সরকার একটা অনড় অবস্থান নিয়েছে। আমরা এই আন্দোলনে এখনও অংশ নিই নি ঠিকই, কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে এই আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন নেই।“
তবে গতবারের আন্দোলনে যেখানে ৩২টি সংগঠন যুক্ত ছিল, এবার যোগ দিয়েছে ৫০টি কৃষক সংগঠন।
রাজধানীর দিকে এগোতে থাকা কৃষক মিছিল আটকানোর জন্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে থেকে দিল্লির আসার সীমান্তগুলিতে বহু-স্তরীয় ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় সারি দিয়ে পেরেক পুঁতে দেওয়া হয়েছে, তারপরে আছে সিমেন্ট ঢালাই করা দেওয়াল আর তারও পরে কাঁটাতারের ব্যারিকেড করা হয়েছে।
এইসব ব্যারিকেডগুলির পেছনে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ আর কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
দিল্লিগামী প্রধান সড়কগুলোতে কন্টেইনার, বাস ও ক্রেনও রাখা হয়েছে।
বছর তিনেক আগের কৃষক আন্দোলনের সময় থেকে শিক্ষা নিয়ে বহু-স্তরীয় ব্যারিকেড গড়া হয়েছে।
ব্যারিকেড করে কৃষকদের পথ আটকানোর চেষ্টা নিয়ে কংগ্রেস প্রশ্ন তুলেছে, “দেশের অন্নদাতারা কি দিল্লিতে এসে বিচার চাইতে পারেন না?”
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা বলেন, “সরকার কি মনে করে যে কৃষকরা দিল্লিতে এসে ক্ষমতা দখল করতে চায়? দেশের কৃষকরা যদি প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের সরকারের কাছে বিচার না চান, তাহলে তারা কোথায় যাবেন? কৃষকের পথে পেরেক ও কাঁটাতার কেন?”
কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দিল্লি পুলিশ এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
সংবাদ সংস্থাগুলি জানাচ্ছে কৃষকদের মিছিলের জন্য ব্যাপক যানজট শুরু হয়েছে।
Leave a Reply