ডেস্ক নিউজ: স্বর্ণের দাম বৃদ্ধিতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। বিশ্বব্যাপীও বাড়ছে দাম। স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকায় অনেকে অলংকার কেনার পরিকল্পনা করলেও তা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়। কারণ, স্বর্ণের অলংকার দিন দিন ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চমূল্যের কারণে ক্রেতা কমে যাওয়ায় জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে জানুয়ারি-১১ ডিসেম্বর দেশের বাজারে ২৮ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। এর মধ্যে দাম কমানো হয়েছে ১১ বার, আর বাড়ানো হয়েছে ১৭ বার। গত জানুয়ারিতে হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। ২১ জুলাই দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো প্রতি ভরি সোনার দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত ৫ নভেম্বর ভরিতে ১ হাজার ৭৫০ টাকা বাড়িয়ে ২২ ক্যারেট এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৪ হাজার ৬২৬ টাকা নির্ধারণ করে বাজুস। এছাড়া ২১ ক্যারেটের স্বর্ণের ভরি ৯৯ হাজার ৯০২ টাকা, ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণের ভরি ৮৫ হাজার ৬১৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭১ হাজার ৩২৫ টাকা। গত ১৮ নভেম্বর স্বর্ণের ভরি ১ হাজার ৭৫০ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৭৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর সোনার দাম ১ লাখ ৯ হাজার ৮৭৫ টাকায় পৌঁছায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত ৭ ডিসেম্বর ভরিপ্রতি দাম অবশ্য ১ হাজার ৭৫০ টাকা কমে।
শুধুমাত্র অক্টোবর মাসেই চার দফায় বেড়েছে স্বর্ণের দাম। ৪ অক্টোবর প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৯৭ হাজার ৪৫ টাকা। ১১ অক্টোবর ২ হাজার ৩৩২ টাকা বেড়ে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৯ হাজার ৩৭৭ টাকা। এর পর ১৫ অক্টোবর প্রতি ভরি স্বর্ণ ১ হাজার ১৬৬ টাকা বা ১ দশমিক ১৭ শতাংশ বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৪৩ টাকায় বিক্রি করতে বলা হয়েছিল।
বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের বিপুল চাহিদা ও জোগানের ভিড়ে বাংলাদেশের বাজার খুবই ছোট। এখানে সুনির্দিষ্ট হিসাবও নেই। তবে মনে করা হয়, দেশে বছরে ২০-৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পুরোনো অলংকার দিয়ে। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে। অবৈধভাবেও প্রচুর স্বর্ণ আসে। জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হয়। শুরুতে কিছু আমদানি হলেও নানা জটিলতায় পরে তা গতি হারায়। বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম কিছুটা বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেকোনো ধরনের বৈশ্বিক সংকট স্বর্ণের দামে প্রভাব ফেলে। যা হতে পারে যুদ্ধ বা মহামারি। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পরে স্বর্ণের দাম বেড়েছে। স্বর্ণের দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে স্বর্ণের বাজারে সুদিন। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি সোনার মূল্যবৃদ্ধি।
যখনই মানুষ ডলারের ওপর আস্থা হারায়, তখন স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাছাকাছি সময়ে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে, ইরান, ইরাক, লিবিয়া এমনকি চীন ও আমেরিকার যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ হয়েছে, তখনও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দর বেড়েছে। এখন কিন্তু পুরো ইউরোপ স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছে। এই কারণে সংকট এলে স্বর্ণের দাম বাড়ে।
ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল এবং স্বর্ণ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নানা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার যেমন থাকে, তেমনি স্বর্ণও গচ্ছিত থাকে। স্বর্ণ একটি পণ্য কিন্তু মূল্য পরিশোধেও এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তেলের দাম বাড়লেও স্বর্ণের দাম বাড়ে। আবার উল্টোটাও হয়। মুদ্রায় অস্থিরতা থাকলে প্রায়শই অপরিশোধিত তেলের মূল্য স্বর্ণে পরিশোধ করা হয়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে স্বর্ণের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেটিই ছিল এত দিন ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম। কিন্তু গত ১ ডিসেম্বর সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায়, মানে আউন্সপ্রতি সোনার দাম ২ হাজার ৭২ ডলারে উঠেছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সমীক্ষায় অনুযায়ী, বিশ্বের ২৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমবর্ধমান মার্কিন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে হতাশায় রয়েছে। এ কারণে তারা আগামী এক বছরের মধ্যে স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়াতে চায়। এর ফলে আগামী বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক খাত থেকেই স্বর্ণের জন্য উচ্চ চাহিদা থাকবে।
স্বর্ণের দামের সঙ্গে চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক আছে। স্বর্ণের চাহিদা মূলত দুইভাবে তৈরি হয়। যেমন গয়নার চাহিদা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। গয়না হিসেবে স্বর্ণ বেশি ব্যবহার করা হয় চীন ও ভারতে। পশ্চিমা দেশগুলোয়ও গয়নার ভালো চাহিদা আছে। চাহিদার মতো সরবরাহও নিশ্চিত হয় দুইভাবে—খনি থেকে নতুন উত্তোলন এবং পুরোনো স্বর্ণ বিক্রি। যদিও স্বর্ণখনি থেকে উত্তোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া।
Leave a Reply