ডেস্ক নিউজ: স্বাধীন ভূখণ্ডের পরে কাঁটাতার পেরিয়ে যাদের পর্বতটাকে দেখার সৌভাগ্য হয় না তাদের জন্যে সুবর্ণ সুযোগ শরতের শীতকালে স্পষ্ট ফুটে উঠে রূপালি কাঞ্চনজঙ্ঘা। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এসে ভ্রমণপিপাসুরা উপভোগ করতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপালি লাবণ্য।
হাত বাড়ালেই যেন শ্বেতশুভ্র হিমালয়! আর একটু এগুলেই হয়তো ছুঁয়ে ফেলা যাবে, চোখ জুড়ানো মন ভোলানো বরফ ঢাকা পর্বতটাকে। হিমালয় মানেই এক বিস্ময়কর রহস্য, সৌন্দর্যের সব রঙ এর মিশ্রণেই অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা।
৭১-এর মুক্তাঞ্চল স্বাধীনতার তীর্থ ভূমি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকেই বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে থাকা হিমালয় পর্বতমালা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত শৃঙ্গ দর্শন করতে ইতোমধ্যে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন। তেঁতুলিয়ার বুক চিরে প্রবাহিত মহানন্দা বিভক্ত করেছে দু-দেশের ভূখণ্ডকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের লীলাভূমি সমতল ভূমির চা-এর রাজ্যের দাঁড়িয়ে সোজা উত্তরে তাকালে চোখে পড়বে সুনীল আকাশ আর হিমালয় এখানে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। হিমালয় পর্বতমালা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকেই দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রধান শৃঙ্গ।
শরৎ ও হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে প্রায় প্রতিদিনই হিমালয় দেখার সুযোগ ঘটে পর্যটকদের। শরতের শেষ দিক হতে শীত পর্যন্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিমালয়। মনোরম আবহে প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের মনে অপার্থিব মায়ার ঘোর সৃষ্টি করে। তেঁতুলিয়া ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় সূর্যের বর্ণিল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত এভারেস্ট শৃঙ্গ। তাই ভোর বেলা থেকে বিকেল পর্যন্ত ডাকবাংলো এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে চলা মহানন্দা নদীর তীরে বসে প্রকৃতি প্রেমীদের আড্ডা। সন্ধ্যা নামার আগে ভিন্ন রূপের মহানন্দা হৃদয় কাড়ে পর্যটকদের। বাংলার বুক চিরে যে সূর্য উঠে ভোরে, সন্ধ্যায় আবার সেই সূর্য ডুব দেয় প্রতিবেশী দেশের হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার আড়ালে। শরৎ, হেমন্ত আর শীত কালেই দেখা মেলে শ্বেতশুভ্র এই কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভোরের আলো মেখে জাগতে শুরু করে। তারপর ক্ষণে ক্ষণে রং পাল্টাতে থাকে।
অপার সৌন্দর্যরে বিস্তৃতি ঘটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় হাসছে পাহাড়। তার শরীর ঘেঁষে চলে গেছে বিস্তৃত হিমালয়। সবুজ আর কালো রঙ মেখে হিমালয়ও হয়ে ওঠে অপরূপ। নানা রং নিয়ে খেলা করে কাঞ্চনজঙ্ঘা। জেগে ওঠার শুরুতে টকটকে লাল। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কমলা, তারপর হলুদ,তারপর সাদা। এরপর হঠাৎ হারিয়ে যায়। মেঘ সরে গেলে আবার উঁকি দেয়। এই লুকোচুরির খেলা চলে সারাবেলা।
কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় এবং হিমালয় পর্বতমালায় ২য় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা প্রায় ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট বা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার। এটি ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে চারটি নদীর উৎপত্তি ঘটেছে নদীগুলো বাংলাদেশেও প্রবাহিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে রয়েছে নানা রকমের লোককাহিনী। এর আশে পাশের অঞ্চলটিকে বলা হয় পর্বত দেবতার বাসস্থান। দেবতার নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা ডেমন । এটি এক প্রকার রাক্ষস। অনেকে বিশ্বাস করে অমরত্বের রহস্য লুকানো আছে এই শ্বেতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গের নিচে।
তবে সবসময় দেখা মেলে না সাদাশুভ্র এই পাহাড়ের। মেঘ আর কুয়াশা মাঝে মাঝেই আড়াল করে রাখে তাকে। তখন অপেক্ষা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ জন্য অনেকে বলে থাকেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য কপালও লাগে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ জেলার যে কোনো প্রান্ত থেকে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য দেখতে বর্তমানে আসতে শুরু করেছে পর্যটকরা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করে পর্যটকরা। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম জানান, টুরিস্টদের আনন্দকে আমরাও উপভোগ করছি। তাই তাদের নিরাপত্তা, থাকা, খাওয়ার বিষয়গুলোকে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোসহ পর্যটন স্থানগুলোকে দৃষ্টি নন্দন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই আয়োজন চলমান।
পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা পিপিএম বলেন, তেঁতুলিয়া টুরিস্ট পুলিশের মাধ্যমে পর্যটকদের নানাভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। দেশের আর সব জায়গার চেয়ে পঞ্চগড়ের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা অনেক ভালো।
তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কাজী আনিসুর রহমান বলেন আমরা এই জেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। টুরিস্টদের সার্বক্ষণিক সহায়তা করা হচ্ছে, যেন তারা অনায়াসে সমতলের চা, মাল্টা, উচ্চফলনশীল আম এবং বিদেশি টিউলিপ বাগানসহ তেঁতুলিয়ার প্রেম প্রকৃতি উপভোগ করতে পারে।
রাজশাহী থেকে পাঁচ বন্ধু মিলে কাঞ্চনজঙ্ঘার লাবণ্য দেখতে ছুটে এসেছেন, শামস ফারাবী, রফিকুল হাসান, সুমন ইসলাম রাব্বি এবং সাদিক, নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই বিশাল পর্বতমালা দেখতে পেয়ে অনেক খুশি তারা। যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততম সময়ের মাঝে এই অবলোকন তাদের মুগ্ধ করেছে পঞ্চগড় হিমালয় পর্বতমালার সমতল অঞ্চল। দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেকেই আসতে পারছে না এবার তেঁতুলিয়ায়। তার পরেও অনেকে বাইক চালিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ছুটে আসছে তেঁতুলিয়ায়।
তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তাই এই জেলাকে বলা হয় হিমালয়ের কন্যা। ৭১-এর মুক্তাঞ্চল স্বাধীনতার তীর্থ ভূমি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকেই হিমালয় পর্বতমালা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ দর্শন শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে।
তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বী বলেন, স্বাধীনতার এই তীর্থভূমি তেঁতুলিযার পাশে অবস্থিত হিমালয় পর্বত মালার অলংকার। ভৌগলিক কারণে এখানকার মানুষগুলোও পাহাড়সম হৃদয়ের অধিকারী। এখানে আসা পর্যটকদের উপলব্ধি এবং প্রকাশ থেকেই যা বেরিয়ে এসেছে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের সকল সহায়তা দিয়ে আসছি।
Leave a Reply