নিজস্ব প্রতিবেদক: ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা-ইলিশ রক্ষার্থে ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বুধবার মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের জন্য নিষিদ্ধ হচ্ছে ইলিশ ধরা। যা অব্যাহত থাকবে আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত। এ সময় মাছ ধরা, পরিবহন, বিপণন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ থাকবে। এতে বেকার হয়ে পড়বেন দুই লাখের অধিক জেলে। যে কারণে অভাব-অনটনের মুখে পড়বেন তারা। তবে নিষেধাজ্ঞার সময়ে পুনর্বাসনের জন্য প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। সেই চাল নির্ধারিত সময়ে বিতরণের দাবি জেলেদের। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর।
চাঁদপুর : নিরাপদ মা-ইলিশের বংশবিস্তারে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনাসহ ৬টি উপকূলীয় এলাকার নদনদীতে বন্ধ হলো ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ। এই নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ আহরণ, বিপণন, মজুদ, ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। তবে মৎস্য সংরক্ষণ আইনে এই ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করলে ভঙ্গকারীরা জেল-জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
জানা গেছে, সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে চাঁদপুরের মৎস্য বিভাগ ও জেলা ট্রাস্কফোর্স। ইতিপূর্বে জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনার প্রায় ৭০ কিলোমিটার অভয়াশ্রম এলাকায় মৎস্য বিভাগ মা-ইলিশের নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দিতে সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়েছে। তবে ইলিশের প্রজনন রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, ২২ দিনের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে টাস্কফোর্স কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করবে। মতলব উত্তর-দক্ষিণ, সদর ও হাইমচরে কোস্টগার্ডের অস্থায়ী ক্যাম্প থাকবে। তবে ইলিশকে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স দিন এবং রাতে অভিযানের পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। এমনকি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যেসব জেলে নদীতে মাছ আহরণ করবে তাদের বিরুদ্ধে মৎস্য আইনে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
প্রজনন মৌসুম সফল করতে ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিছুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার ইলিশ পদ্মা-মেঘনায় ধরা পড়েছে কম। তাই আমরা আশা করি অনেক বড় বড় সাইজের ইলিশ রয়েছে। যা থেকে প্রচুর ইলিশ ডিম ছাড়বে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৪ উপজেলায় ৫১ হাজার ১৯০ জেলে পরিবার ইলিশ আহরণের ওপর নির্ভর করে চলে। নিষেধাজ্ঞার সময়ে এ বছরও সরকারের পক্ষ থেকে নিবন্ধিত ৫১ হাজার জেলেকে বিগত সময়ের মতো খাদ্য সহায়তা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে গতকাল বুধবার সকালে সদরের মেঘনাপারের জেলেপল্লীর আনন্দবাজার, তরপুরচণ্ডী ও আশপাশের এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে অনেক জেলেই নৌকা ও জাল ডাঙায় উঠিয়ে রেখেছেন এবং জাল মেরামত করছেন তুলে রাখার জন্য। আবার কোনো কোনো জেলে মাছ আহরণ থেকে বিরত থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ওই সময় সদরের আনন্দবাজার এলাকার জেলে আল আমিন ও মানিক মিয়া বলেন, সরকার যে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তা আমরা মানি। কিন্তু যে পরিমাণ খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়, তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, মা-ইলিশের নিরাপদ প্রজননের জন্য আমরা নদী উপকূলীয় উপজেলা মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলায় সচেতনতা সভা করেছি। জেলেরা আমাদের বলেছে তারা ইলিশ আহরণ থেকে বিরত থাকবে।
কক্সবাজার : প্রজনন মৌসুম ও ইলিশ সুরক্ষায় ১১ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এ সময় সাগরে কোনো ধরনের মাছ ধরা যাবে না। এদিকে, গেল ভরা মৌসুমে বৈরী আবহাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতায় আশানুরূপ ইলিশ না পেয়ে হতাশ জেলে, বোট মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তার মধ্যে ২২ দিনের এই নিষেজ্ঞায় কীভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলেরা। প্রশাসন বলছে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হবে। তবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রদান করা হবে ত্রাণ সহায়তাও। কক্সবাজারের ২৪ হাজার ৪০ জেলে পরিবারকে দেওয়া হবে ৬০২ মেট্রিক টন চাল।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গত ৯ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা সভা করে সিদান্ত নিয়েছি যে, ১২ অক্টোবর পর থেকে সাগরে মাছ ধরার সকল ট্রলার বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ মৎস্য অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, র্যাব ও অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে থাকবে। এ ছাড়া জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল বিতরণে অনিয়মের খবর পেলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাটে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এরই মধ্যে প্রায় ৯৫ ভাগ মাছ ধরার ট্রলার উপকূলে ফিরে এসেছে। এদিকে জেলেরা বলছেন বৈরী আবহাওয়াসহ নানা করণে গেল ভরা মৌসুমে আশানুরূপ ইলিশ পায়নি তারা। তার মধ্যে এই বন্ধে কীভাবে জীবন চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের জেলে লিয়াকত মিয়া জানান, ‘বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২-১ দিন পর পর সিগন্যাল। যার ফলে ঠিকমতো মাছ আহরণ হয়নি। তার মধ্যে শুরু হয়েছে ২২ দিনের বন্ধ। জানি না সামনের দিনগুলোয় কী হয়?
ফিশারি ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী সৈয়দ আলম জানান, ‘ধারদেনা করে ব্যবসা করেছি। সাগরে ইলিশ মাছ পড়লেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সুবিধা করতে পারিনি। তার মধ্যে পড়েছে আবার ২২ দিনের বন্ধ। এই অবস্থায় ব্যবসায় লাভ দূরের কথা কোনোভাবে দেনা শোধরাতে পারব কিনা সন্দেহ।’
কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন জানান, গেল ৬৫ দিন অবরোধের পর জেলেরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ পায়নি। এর বড় কারণ ছিল বৈরী আবহাওয়া। তাই মাছ ধরা বন্ধের দিনগুলোতে জেলেদের যথাযথ সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান জানান, বিভিন্ন গবেষণা ও ফলাফলে দেখা যায় এই ২২ দিনেই ইলিশ বেশি পরিমাণে ডিম ছাড়ে। তাই এই সময়টা সমুদ্র ফ্রি রাখতে হবে। বন্ধের সময় বেকার হয়ে যাওয়া ২৪ হাজার ৪০ জেলে পরিবারকে ৬০২ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হবে।
আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা- প্রাণিসম্পদমন্ত্রী : এদিকে মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলাকালে আইন লঙ্ঘন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৩’ বাস্তবায়ন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ কথা জানান।
প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রেজাউল করিম বলেন, মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলাকালে যারা আইন লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মা-ইলিশ রক্ষায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, আইন অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং মা-ইলিশ সংরক্ষণের সময়ে কোনো মাছ ধরা নৌযান যাতে নদী বা সাগরে যেতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত বছর মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের ২২ দিনে প্রায় ৫২ শতাংশ মা-ইলিশ ডিম ছাড়তে সক্ষম হয়। ফলে গত বছর প্রায় ৮ লক্ষ ৫ হাজার ৫১৫ কেজি ডিম উৎপাদন হয়েছে, যা থেকে প্রায় ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি জাটকা ইলিশ সংখ্যায় যুক্ত হয়েছে।
মন্ত্রী আরও জানান, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল ২.৯৮ লাখ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় ইলিশের আহরণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ, অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল কাইয়ূম, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
Leave a Reply