কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) : ঢাকার কেরানীগঞ্জে চাঞ্চল্যকর ১০ম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র ইজিবাইক চালক শাকিল (১৭)-এর হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করে হত্যাকান্ডে জড়িত ৪ জন আসামিকে গ্রেফতার, হত্যায় ব্যবহৃত রক্তমাখা চাকু ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো: ইব্রাহিম চান (২১), মোঃ শরিফাত (২০), সাব্বির হোসেন মেহেদী (২২) ও জনি (২০)।
রবিবার দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামান এসব কথা জানান।
তিনি বলেন, মদ পার্টির টাকার জন্য ৪ কিশোর মিলে গলাকেটে হত্যা করে দশম শ্রেণীর ছাত্র অটোরিকশা চালক শাকিল কে । গত ১৯ মে সকাল ৬ টার দিকে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা পুলিশ খবর পায় যে, ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কোন্ডা মঠবাড়ী পদ্মা রেলওয়ে সেতুর নিচে সাবেক চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন এর পরিত্যক্ত ইটের খোলার ভিতরে একজন ছেলের গলা কাঁটা লাশ পড়ে আছে। সে সংবাদ পাওয়ার পর দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় এবং লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে, মৃতদেহটি একই ইউনিয়নের জাজিরা গ্রামের মৃত সিদ্দিক মিয়ার ছেলে শাকিলের (১৭)। ঘটনাস্থলে উপস্থিত শাকিলের পরিবারের সদস্যরা লাশটি শাকিলের মর্মে সনাক্ত করে এবং পুলিশকে জানায় যে, শাকিল ১০ম শ্রেণীর ছাত্র, তার বাবা ছোটবেলায় মারা যায়, বাসায় শাকিল তার অসুস্থ মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে থাকতো। নিজের পড়াশুনা, মাষের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মিটানোর জন্য শাকিল স্কুল শেষে প্রতিদিন বিকেল হতে রাত ১০ টা পর্যন্ত ইজিবাইক চালায়। শাকিলের পরিবার জানায় প্রতিদিনের মতো শাকিল গত ১৮ মে বৃহস্পতিবার বিকেলে তার ইজিবাইক নিয়ে বের হলেও রাতে আর বাসায় ফিরে আসে নাই। পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করার সময় দেখতে পায় যে, মৃত শাকিলের গলা ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করে মাথা দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে এবং পিঠে এলোপাথাড়ি ১১টি চাকু মারার ক্ষত আছে এবং পেটের ডান পাশে চাকু মারার ফলে নাতি ভুড়ি বের হয়ে গিয়েছে। সুরতহাল শেষে পুলিশ শাকিলের মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতাল ঢাকায় প্রেরন করে। এ ঘটনায় পরবর্তীতে শকিলের বড় বোন সীমা (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
চাঞ্চল্যকর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত আসামীদের দ্রুত গ্রেফতার করার জন্য ক্রাইমসিন হতে তদন্ত টিম প্রাথমিকভাবে ধারনা করে যে, অজ্ঞাতনামা আসামীরা ইজিবাইক ছিনতাই এর উদ্দেশে শাকিলকে নির্জন পরিত্যক্ত ইটখোলায় নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তদন্ত টিম ঘটনাস্থল ও এর আশেপাশের এলাকায় তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রয়োগ করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামীদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আসামীরা ইতিমধ্যে মোবাইল বন্ধ করে বিভিন্ন জেলায় পালিয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, হত্যাকান্ডে জড়িত আসামীদের দ্রুত গ্রেফতারের লক্ষ্যে জনাব শাহাবুদ্দিন কবীর, বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কেরাণীগঞ্জ সার্কেল এর সরাসরি তত্ত্ববধানে এবং মোহাম্মদ শাহজামান, অফিসার ইনচার্জ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এর সার্বিক সহযোগিতায় ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মাসুদুর রহমান এর নেতৃত্বে একটি চৌকষ আভিযানিক দল টানা ২৪ ঘন্টা ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামী ইব্রাহিম চান (২১)-কে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে মোঃ শরিফাত (২০)-কে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে, সাব্বির হোসেন মেহেদী (২২)-কে ধামরাই থেকে এবং জনি (২০)-কে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্ৰেফতারকৃত আসামীরা হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে এবং পরবর্তীতে আসামীদের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি রক্তমাখা সুইসগিয়ার চাকু, আসামীদের ব্যবহৃত রক্তমাখা ও লুন্ঠিত ইজিবাইকটি পুলিশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। গ্ৰেফতারকৃত আসামিরা সবাই মাদকাসক্ত এবং কিশোর গ্যাং-এর সক্রিয় সদস্য।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ১৮ মে আসামিরা একটা ইজিবাইক ছিনতাই করে তার ব্যাটারী বিক্রির টাকা দিয়ে মদের পার্টি করবে বলে পরিকল্পনা করেছিল। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক সেদিন সন্ধ্যায় আসামিরা ইব্রাহিম চানের সিএনজি নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাউটাইল ঘাটে টার্গেট ইজিবাইকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পরবর্তীতে কোন টার্গেট ইজিবাইক না পেয়ে শরাফত ও শুনি-কাউটাল ঘাট এলাকা থেকে সামনে এগিয়ে গিয়ে শাকিলকে পায়। শাকিল জনির পূর্ব পরিচিত বিধায় শাকিলকে নির্জন জায়গায় ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে মনে করে আসামিরা শাকিলের ইজিবাইকটা ভাড়া করে। জনি, শরাফাত এবং সাব্বির শাকিলের ইজিবাইকে উঠে ঘুরতে ঘুরতে শাকিলকে নিয়ে মঠবাড়ী পরিত্যক্ত ইটখোলায় যায়। অপরদিকে ইব্রাহিম চান সিএনজি নিয়ে ওদের পিছু পিছু আসে। তারপর ঘটনাস্থলে পৌঁছানো মাত্রই পূর্বপরিকল্পনা মাফিক শরফাত সুযোগ বুঝে সুইসগিয়ার দিয়ে শাকিল এর গলায় আঘাত করে। এতে শাকিল ইজিবাইক থেকে পড়ে যায় এবং গলা চেপে ধরে চিৎকার শুরু করে। তখন জনি পেছন থেকে শাকিলের পিঠে এলোপাথাড়ি চাকু মারতে থাকে। কিন্তু তারপরও শাকিল চিৎকার ও দাপাদাপি করতে থাকলে জনি, সাব্বির এবং ইব্রাহিম চান শাকিলের মাথা ও হাত-পা চেপে ধরো এবং শরাফাত শাকিলকে সুইসগিয়ার দিয়ে মাথার সামনে-পেছনে জবাই করে মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর শরাফত, জনি ও ইব্রাহিম চান সিএনজিতে করে চলে যায় এবং সাব্বির ওদের পেছন পেছনে মৃত শাকিলের ইজিবাইক চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। মূলত আসামীদের মদের পাটির টাকার জন্যই তারা পূর্ব পরিচিত ইজিবাইক চালক শাকিলকে হত্যা করে তার ইজিবাইক ছিনতাই করে।
Leave a Reply