নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে হাসেম ফুডসের আগুনে পোড়া ছয়তলা ভবনটি যেন বন্দিশালা। প্রতিটি তলায় খোপ খোপ করে জিআই নেটের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। তালা দেয়া এসব খোপে কাজ করতেন শ্রমিকরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগুন লাগার পর কারখানার ব্যবস্থাপক মাহবুব শ্রমিকদের বের হতে বাধা দেন।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, কারখানায় ছিল না পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাও।
আগুনে ছেয়ে গেছে ভবনের নিচের তলা। তাই সিঁড়ি দিয়ে নামার উপায় নেই। এমন মুহুর্তে সহকর্মীদের জীবন বাঁচাতে ফর্ক লিফট নিয়ে এগিয়ে আসেন চালক। দুই ও তিনতলা থেকে লাফিয়ে আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা শ্রমিকদের।
দুই ও তিনতলায় কাজ করা শ্রমিকদের একটি অংশ পাশের ভবনের সংযোগ সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। কিছু শ্রমিক ভবনের পূর্বদিক দিয়ে লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। তবে আটকা পড়েন চার ও পাঁচ তলার শ্রমিক ও কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রমিকরা বের হতে চাইলে বাধা দেন সেকশন ম্যানেজার মাহবুব। আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা নিচে নামতে পারেননি, উপরেও উঠতে পারেননি। ফলে পুড়ে মরতে হয় অনেককে। আগুনে পুড়ে মারা যান সেকশন ম্যানেজার মাহবুবও। পোড়া ভবন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি তলা নানাভাগে বিভক্ত এবং আটকানো নেটের বেড়া দিয়ে। রয়েছে তালাও। ফায়ারসার্ভিস কর্মকর্তাদের ধারণা, শ্রমিকদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশাল এই ভবনের প্রতিটি তলার ৩৪ হাজার স্কয়ারফিটের। অথচ চলাচলের জন্য মাত্র দুটি সিঁড়ি। ফ্লোরগুলো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলে শ্রমিকরা সিঁড়ির পথ খুঁজে পাননি। নিচের তলায় আগুন নেভানোর একটা পানির পাইপ দেখা গেলেও পাম্প ছিল কিনা নিশ্চিত নয় ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারি পরিচালক সালেহ উদ্দিন জানান, ভবনটি ব্যবহারে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। নিচের ও উপরের তলায় ছিল গুদাম। আর মাঝের তলায় কারখানা। নিচের তলায় গুদামে আগুন লাগায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং শ্রমিকদের বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
ছয়তলা ভবনে প্রচুর প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কার্টনসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ হয়ে ওঠে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ কারণে আগুন দ্রুত অন্য ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতেও বেগ পেতে হয়। সিঁড়ির দরোজা খোলা থাকলে প্রাণহানি কম হতো বলে প্রাথমিক তদন্তে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৪৯টি লাশ উদ্ধারের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক সিদ্দীক মাহমুদ জুলফিকার রহমান।
জুলফিকার রহমান, জানান, আগুন নেভানোর পর আবার আগুন জ্বলে উঠছিল। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
কারখানা থেকে দুপুরে ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ জনে। তলায় তল্লাশি শেষে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আগুন লাগে ওই কারখানায়। মুহূর্তে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ছয়তলা ভবনটিতে।
তখন সেখানে কাজ করছিলেন অন্তত চারশ কর্মী। কলাপসিবল গেইট বন্ধ থাকায় জীবন বাঁচাতে বেশ কয়েক জনকে লাফিয়ে পড়তে দেখা যায় ছাদ থেকে। শুক্রবার পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে একে একে বের করা হয় মরদেহ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
Leave a Reply